আজ ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আধুনিক সভ্যতার বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গরু’র গাড়ি!

আশরাফুল হক, লালমনিরহাট।
কালের বিবর্তনে মাঠে-ঘাটে পথে-প্রান্তরে এখন আর শোনা যায় গাড়িয়ালের কন্ঠে সেই ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি গান গুলো। “ওকি গাড়িয়াল ভাই–কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে” গরু বা মহিষের গাড়ি নিয়ে উচ্চ স্বরে এমন গানের হাঁক আর শোনা যায়না।

গ্রামের মেঠোপথে কৃষি পণ্য পরিবহনের কাজে এক সময় ব্যবহার হতো গরুর গাড়ি নামে একপ্রকার যান। গরুর গাড়ি হল দুই চাকাবিশিষ্ট টানা একপ্রকার যান। এই যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুতে এই গাড়ি টানা হয়। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। এই হলো গরুর গাড়ি।

শুধু যান হিসেবেই নয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে গরুর গাড়ি। গান, গল্প, কবিতার শেষ নেই। গরুর গাড়ি নিয়ে কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া বিখ্যাত গান “আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে- ধুতুর, ধুতুর, ধুতুর ধু সানাই বাজিয়ে, যাব তোমায় শ্বশুরবাড়ি নিয়ে” আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে।

কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিবর্তনে যন্ত্রচালিত লাঙল বা পাওয়ার টিলার এবং নানা যন্ত্রযানের উদ্ভবের ফলে বিলুপ্তির পথে আজ ‘গরুর গাড়ি’। মৎস্য ও শষ্য ভান্ডার খ্যাত লালমনিরহাট জেলার সর্বত্রই এক সময়ের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল গ্রামবাংলার জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহি সেই গরুর গাড়ি আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন নতুন প্রযুক্তির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটেছে। পক্ষান্তরে হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের এই ঐতিহ্য।

জানা গেছে, গরুর গাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। খ্রীষ্টজন্মের ১৫০০ – ১৬০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল খুবই বেশি। যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম বাংলায় এ ঐতিহ্য আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় পল্লী এলাকার জনপ্রিয় বাহন ছিল গরুর গাড়ি। বিশেষ করে এই জনপদে কৃষি ফসল ও মানুষ বহনের জনপ্রিয় বাহন ছিল এটি।

যুগের পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই বাহন। বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযানের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তাই এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমান যুগ হচ্ছে যান্ত্রিক যুগ। এখনকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরি, নসিমন-করিমনসহ বিভিন্ন মালবাহী গাড়ি। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা ইত্যাদি। ফলে গ্রামাঞ্চলেও আর চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি। অথচ গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো, এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ফলে ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতিও করে না। এটি পরিবেশবান্ধব একটি যানবাহন। আবার ধীর গতির কারণে এতে তেমন কোনো দুর্ঘটনারও আশংকা থাকে না। অথচ যুগের পরিবর্তনে কালের অতল গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় এই গরুরগাড়ি প্রচলন।

জেলা সদরের কাজীর চওড়া গ্রামের চটকু গাড়িয়াল বলেন, গরু’র গাড়িতে করে আমরা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বিভিন্ন মালামাল পৌঁছে দিতাম। বিশেষ করে পাট, ধান, গম, তামাক, শরিষা, আখ ইত্যাদি ফসল আমরা সব সময় গরুর গাড়িতে ভাড়ায় খাটতাম। এখন আর সেই গরুর গাড়ি চোখে পড়েনা।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা বাজারের লোকমান গাড়িয়াল বলেন, গরুর গাড়ি ছাড়া এক সময় বিয়ের বাড়িতে যাওয়ার মত যান-বাহন সচারাচর পাওয়া যেতনা। এই গরুর গাড়িতে চড়ে মানুষ বিয়ে-সাধির কাজ চলাতো। শহরের ছেলে মেয়েরা তো দূরের কথা বর্তমানে গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ি শব্দটির সাথে তেমন পরিচিত নয়। এটা দেখতে কেমন? চলে কীভাবে?

গরুর গাড়ি বিষয়ে সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খন্দকার সেরাজুল হক রানা বলেন, আমাদের নিজের বাড়িতে গরুর গাড়ি ছিলো, আমরা সেই গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন হাটে বাজারে যেতাম। কালের বিবর্তন আর সময়ের ব্যবধানে আজ আর চোখে পড়েনা সেই দৃশ্য। তাই আমাদের উচিত অতিথের ঐতিহ্যবাহী এক সময়ের চলাচলের গরুর গাড়ি যেন গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে না যায়।

এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ...